Sunday 30 January 2022

নুহীন কে??


"নুহিন কে?"

অরিত্রীকে আমি এই প্রশ্নটা করতে গিয়ে অসংখ্যবার চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। কারন, সে মুহূর্তের মধ্যেই চট করে একটা মিথ্যা বানিয়ে বলে ফেলবে আর আমাকে সন্দেহবাজ বলে ব্লেইম করবে। এরকমটা প্রায়ই হতো  

একদিন সন্ধ্যায় অনিক স্যারের কোচিং এ (ওই ব্যাচ এ আমি সে আর একজন ছিলো শুধু) আমাকে লুকিয়ে সে নুহিনকে টেক্সট করছিলো "আমি সাড়ে দশটার দিকে বের হবো, তুমি স্টেশনে থেকো" 

আমি দেখেও কিছু না দেখার ভান করে স্বাভাবিক আচরণ করে গেলাম। কোচিং শেষে ফেরার পথে সে আমাকে জানালো হয়তো আগামীকাল কোচিং এ আসতে পারবে না; তার আম্মুর সাথে ফুফুর বাড়িতে যাবে, তার ফুফু ভীষন অসুস্থ। আমি বললাম আচ্ছা। 

বাসায় এসে মাথাভর্তি জেদ নিয়ে ফেসবুকে নুহিন'কে খোঁজা শুরু করলাম। নুহিন'কে পেলাম না (আমি নুহিন এর প্রোফাইল পিকচার চিনতাম)। আরেকটা আইডি খুলে খোঁজা শুরু করলাম, পেয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম নুহিনের আইডি থেকে আমাকে ব্লক দেয়া। 

যাইহোক, নুহিনের অনেকগুলো পোষ্টে ওর কমেন্ট দেখতে পেলাম। একটা ছোট্ট ভিরমি খেলাম। আস্তে আস্তে রাগ বাড়তেছে, এরমধ্যে ১৭ টা সিগারেট শেষ। 

দুদিন পর....
অরিত্রী ফোন দিয়ে বললো, "কোচিং এ যাওয়ার সময় অপেক্ষা করিও" আমি, "আচ্ছা"
একসাথে কোচিং এ গেলাম , জানতে পারলাম ওর ফুফু'র অবস্থা খুব একটা ভালো না ডাক্তার দেখানোর জন্য ওদের বাড়িতে নিয়ে আসবে, আপাতত ফুফুর দেখাশোনা করার জন্য ব্যস্ত থাকবে তেমন মেসেজ/ফোন দিতে পারবেনা। 
আমি বললাম, "আরে, এতো প্যারা নেয়ার কিছু নেই আমাদের কথা বলার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে। ভাগ্য ভালো না হলে, কারো সেবা করার সুযোগ খুব একটা পাওয়া যায়না। তোমার ফুফুর সেবা করার সুযোগ পেয়েছো মানে তুমি ভাগ্যবতী, আর তোমাকে পেয়ে আমিও ভাগ্যবান"

যথারীতি আমাদের সবকিছুই আগের মতো চলছিলো। শুধু বাড়িতে গেলে তেমন কথা হতো না। আমি জানা সত্যকেও মিথ্যা বলে নিজের মাথা থেকে নুহিনের ভুতটাকে তাড়াতে চাচ্ছি। এদিকে তার ফুফু ও সুস্থ হচ্ছে না (ওই মিথ্যে ফুফু টা মারা গেলেও হয়তো আমাদের সবকিছু ঠিক হয়ে যেতো)। 

এরপর ঘটনার মোড় একটু একটু করে ঘুরতে লাগলো...
একদিন আমাকে বললো, তার আব্বু-আম্মু তাকে পড়াশোনার জন্য চট্টগ্রাম আপুর বাসায় পাঠিয়ে দিবে। এলাকায় থাকলে পড়াশোনা হবেনা, ছেলেরা বিরক্ত করে, প্রতিবেশীরা বিয়ে দিয়ে দিতে বলে ইত্যাদি। 

এবার আর আমি আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ধরে রাখতে পারলাম না। অরিত্রীর সাথে তোলা একটা ছবি নতুন আইডির প্রোফাইলে দিয়ে নুহিনকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিলাম। সাথে সাথেই এক্সেপ্ট করে মেসেজ দিলো, 
- ভাইয়া, কেমন আছেন?
- আপনি আমাকে চিনেন?
- হ্যাঁ, চিনবো না কেনো? আপনি অরিত্রীর কাজিন, অরিত্রীকে পছন্দ করেন। আর অরিত্রীর ফ্রেন্ডলিস্টের ছেলেদেরকে মেসেজ দিয়ে বলেন আপনি নাকি ওর বয়ফ্রেন্ড। অরিত্রীর ফ্যামিলিও অপনাজে তেমন পছন্দ করেনা। তাই অরিত্রী বলছিলো আপনাকে ব্লক করে রাখতে। 

সেই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছিলো কোনো এক অদৃশ্য শক্তির চতুর্মুখী চাপে আমি একটা ধূলিকনায় পরিণত হচ্ছি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, "ভাইয়া আসলে মানুষের লাইফে পরিবর্তন আসে, আমিও আর আগের মতো নেই। দিন পাঁচেক হলো আমি একটা রিলেশনে গেলাম, যেহেতু অরিত্রীর ফ্যামিলি আমাকে চাচ্ছে না শুধু শুধু তার পিছনে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমিও চাই আমার বোনটা(কাজিন) ভালো থাকুক। 

অনেক কথাবার্তার পরে নুহিন আমাকে জানালো, "তারা কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করবে"।। আসলে মানুষ আমাকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে অনেক কথা বলে ফেলে, নুহিন-ও তাই করলো। এরপর কথায় কথায় নুহিন এর থেকে অরিত্রীর সাথে তোলা ছবি নিলাম। ওদের জন্য দোয়া করে শেষে বললাম, "ভাইয়া, অরিত্রীকে বলবেন না আমাদের যে কথা হয়েছে" 

পরেরদিন শুক্রবার ছিলো, কোচিং বন্ধ। ওই শুক্রবার টা যেতেই চাচ্ছিলো না। দিন গিয়ে রাত শেষ হয়ে আবার শনিবার বিকেল হওয়ার সময়টা আমার কাছে এক মহাকাল মনে হচ্ছিল। এরমধ্যে অরিত্রীর সাথে টুকটাক কথা হলো। আমরা কোচিং এ গেলাম, আমার মুড অফ। অরিত্রী বারবার বিভিন্ন কথা বলে আমাকে হাসাতে চাইলো, মেয়েটা সবসময়ই এই খেলায় জিতে যায়। কিন্তু আজ পারেনি, আজ আমার মাথায় আটকে থাকা ছোট্ট প্রশ্নটা পাহাড় সমান আকার ধারন করলো। 

কোচিং শেষে অরিত্রী হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলো, আমাকে চেপে ধরলো কি হয়েছে বলার জন্য। আমি তবুও বলার সাহস পেলাম না, যদি সত্যি সত্যিই নুহিনের সাথে অরিত্রীর কোনো সম্পর্ক না থাকে!! শেষমেশ সাহস নিয়ে জেদের বশে বলে ফেললাম, 
- নুহিন কে?
সাথে সাথে অরিত্রী হেঁসে বললো, "আরে এই কথা জানার জন্য এতো সময় নিছো তুমি? আমাকে আগে বললেই তো হতো। শুনো, নুহিন আমার কাজিন, আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু আমার ফ্যামিলি ওকে পছন্দ করেনা, আর সে আমার ফ্রেন্ডলিস্টের ছেলেদেরকে মেসেজ দিয়ে বলে সে নাকি আমার বয়ফ্রেন্ড। তোমার সাথেও কি এমনটা করেছিলো?"

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে সব প্রমান অরিত্রীর সামনে তুলে ধরলাম। ঠিক তখনই অরিত্রী অগ্নিরূপ ধারণ করে আমাকে বললো, "এই আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসের রূপ? আমার ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করতে লজ্জা লাগলো না তোমার? তুমি থাকো তোমার গোয়েন্দাগিরি নিয়ে আমি চললাম"

কথাটা বলেই অরিত্রী বইখাতা ব্যাগে ঢুকিয়ে হাঁটা ধরলো। কিন্তু কলমটা নিতে ভুলে গেছে। আচ্ছা অরিত্রী কি সবসময়ই রেগে গেলে কলম নিতে ভুলে যায়? নাকি কলমটা আমার জন্য রেখে যাওয়া তার শেষ স্মৃতি ছিলো, কে জানে।

হটাৎ ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় আমি কোনো উত্তর খুজে পেলাম না, অথচ মাথাভর্তি হয়ে গেলো হাজারটা প্রশ্নে!! আসলেই কি এই গোপন সত্যটা জেনে ভুল করে ফেললাম? নাহলে তো আরো কিছুদিন অরিত্রীকে কাছে পেতাম। অরিত্রীর ছোট্ট আঙ্গুলগুলো ধরে সন্ধ্যার পর রোড ক্রসিং করে রাস্তার দক্ষিণপাশ দিয়ে আবছা অন্ধকারে হাঁটতে পারতাম। অরিত্রী রাস্তা পার হতে ভয় পেতো, আচ্ছা নুহিন কি ঠিকমতো রাস্তা পার করাতে পারে? অরিত্রী কি নুহিনের হাতকে আমার হাতের মতোই ভরসা করে? নুহিনের হাত ধরলে কি অরিত্রী মনে মনে আমার হাত টাই ধরে? হয়তো অরিত্রী আমাকে খুব বেশি ভালোবাসে তাই আমার উপর খুব বেশি রাগ ঝাড়লো।

যাই হোক, অরিত্রী আমার খুব যত্নের বস্তু এভাবে হারাবে না। দুয়েকদিন পর হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আমার ও উচিৎ হয়নি এভাবে অরিত্রীকে এভাবে ব্লেইম করা, থাকুক না ওর রিলেশন দিনশেষে ও তো আমারই। অরিত্রী কখনোই নুহিনকে বিয়ে করতে পারেনা, নুহিন আসলেই ওর কাজিন। আচ্ছা আমি অরিত্রীকে বিশ্বাস না করে কিভাবে নুহিনকে বিশ্বাস করলাম? আমি আসলেই খুব খারাপ। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রাস্তায় চলে এলাম খেয়াল করিনি। একটা মালবাহী অল্পের জন্য আমাকে পিষে যায়নি, ট্রাক চালকের উপর রাগ উঠলো প্রচুর। এতো ভালো ড্রাইভিং জানলে তুই ট্রাক চালাবি কেনো? বিমান চালানোর ট্রাই কর। রাস্তাঘাটে টুকটাক এক্সিডেন্ট করতে না পারলে এটা কেমন ড্রাইভার। 

ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে চলে গেলাম পদ্মার পাড়ে, শুনেছি পদ্মা নাকি সর্বনাশা নদী। আমার কিছুই নেই তাই আমার সর্বনাশের ভয় ও নেই। পদ্মার পানিতে চাঁদের প্রতিবিম্ব আর এর মৃদু বাতাসের মাঝে বসে ভাবছি চাঁদের আলো যদি অরিত্রীর মুখে পড়ে আর বাতাসে তার চুল নড়তে থাকলে কতোটা মায়াবী লাগবে!! এমনিতেও তাকে প্রচন্ড রকমের মায়াবী লাগে। বিধাতা সব মায়া যেনো মুঠো ভরে তার উপর ঢেলে দিয়েছেন। এসবের মাঝে কখন যে এক গভীর ঘোরে হারিয়ে গেলাম বুঝতে পারিনি। সকালে ঘুম ভাঙলো নদীটাকে আর রাতের মতো সুন্দর লাগেনি। 

আমি সোজা চলে গেলাম, অরিত্রীদের বাড়িতে। ভাবলাম আমার এই ক্লান্ত চেহারা দেখেও হয়তো অরিত্রীর মায়া লেগে যাবে, অরিত্রী আমার সবকিছু ক্ষমা করে দিবে। আমার তখনও মনে হচ্ছিলো না সব দোষ তারই ছিলো। আমার বারবার মনে হচ্ছে তার গোপন সত্যটা জেনেই ভুল করলাম। যাইহোক, তাদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম অরিত্রী নাকি কাল রাতে নুহিন নামের এক ছেলের সাথে চলে গেছে..... সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিলো সবাই মিথ্যাবাদী নয়তো আমি উল্টাপাল্টা ভাবতে গিয়ে পাগল হয়ে গেছি। এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি অরিত্রী আমাকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরতে পারে....

No comments:

Post a Comment

চারুর স্মৃতিপট এর কিছুকথা

- যেদিন আকাশে অনেক তারা ছিল সেদিন তুমি আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে মধ্যরাতে ছাদে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলে। তুমি গোধূলি ভালোবাসতে, কৃষি কলেজের ঘাঁষগ...